নষ্ট নীড়ের উপাখ্যান
স্মরজিৎ দত্ত
এই গলির নাম অনেক উপন্যাস অনেকে গল্প আলোকিত করে রেখেছে। সেই গলির মুখেই আধ ভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে বাসন্তী। সন্ধে থেকে তেমন খদ্দের জোটেনি তার কপালে । ঘড়ির কাঁটা বলছে প্রায় মধ্যরাত। হঠাৎই একটি সাদা রংয়ের প্রাইভেট গাড়ি বাসন্তীর সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ির জানলার কাঁচ নামিয়ে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা আধ বয়সী লোকটি তাকিয়ে থাকে বাসন্তীর দিকে। প্রথমে তেমনভাবে লক্ষ্য না করলেও বাসন্তী এবার লক্ষ্য করে । অনায়াসে বলে ওঠে কি ব্যাপার রেট দেবেন তো ঠিক করে? আধ বয়সী লোকটি হঠাৎই মুশরে পড়ে। ফিরে যেতে হয় তাকে দীর্ঘ 25 বছর পেছনে একই গ্রামে একই খেলার সাথী ছিল ওই বাসন্তী আর সে।
কিছুটা মুখ বাড়িয়ে এবার ওই আঁধ বয়সী লোকটি বলে ওঠে তুমি ভালো আছো? বহুবছর তোমাকে খুজেছি। বুঝতে পারিনি আজ এভাবে তোমার সাথে আমার সাক্ষাৎ হবে। বাসন্তী হঠাৎ বলে এই, এই পাড়ায় এসে বহু লোকই আমাদেরকে বলে কিরে কেমন আছিস তুই আমার অনেক চেনা, ওসব কথায় না এখন আর মন ভেজে না। অনেক বছর হয়ে গেছে এ জগতে বিরাজ করছি। বল ঠিকমতো পয়সা দিলে যাব নইলে সোজা রাস্তা দেখছিস চলে যা।
আধ বয়সী লোকটা একটা সিগারেট ধরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। অফিস থেকে আজ বেরোতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়িতে ঢুকলেই সেই একাকীত্ব জীবন তমালি তার স্ত্রী আজ বহু বছর হয়েছে স্বতন্ত্র থাকে। তার মেয়েকে নিয়ে। গাড়ি থেকে নেমে এসে সোজাসোজি বাসন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ায়। আমি রঞ্জন ওরফে তপু চিনতে পারছো? বাসন্তী প্রথম এরাবার চেষ্টা করে; এই, এ জায়গায় এসে না কে তপু ? কে কি? কিছু কাজে দেবে না । পয়সা নেব কাজ দেব এছাড়া অন্য কিছু এ জায়গায় চলে না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎই মাছ বয়সী লোকটি বলতে থাকে-
"আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।"
যে বাসন্তী দাব্রি দিয়ে বলে উঠেছিল, এ পাড়ায় এসে এমন পরিচিতির তালবাহানা অনেকেই করে। হঠাৎই এই কবিতার অংশ শুনে সেও কেমন যেন দুম মেরে যায়। ঠিক শুনছে তো সে? নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারে না। সামনে দাঁড়ানো সেই রঞ্জন কিনা? মাথাটা হঠাৎ তার জ্যাম হয়ে যায়। কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই ,হঠাৎই বলে বসে আপনার কাছে সিগারেট আছে আমাকে একটা দিন তো। আধ বয়সী লোকটি সিগারেটের প্যাকেটটা তার হাতে দিতে গিয়েও বলে গ্রামের আধুনিক মেয়ে ছিলে তুমি সে সময়ে গ্রামে তুমিই প্রথম সিগারেট হাতে তুলে ছিলে । তবে কোন এক সময় তুমি আমায় কথা দিয়েছিলে আর সিগারেট খাবে না। সেই গ্রাম তুমি হয়তো ভুলে গেছো কিন্তু গ্রাম তোমায় ভোলেনি। বাসন্তী এবার কেন জানি মুশরে পড়ে। হঠাৎ বলে ওঠে তুমি রঞ্জন? হঠাৎ তুমিই বা এপাড়ায়? বিয়ে করোনি? বউ কোথায়? এত রাতে বাড়ি না গিয়ে ড্রাইভ করে কোথায় যাচ্ছিলে? তোমার তো এমন ধরনের কোন নেশা ছিল বলে আমার জানা নেই।
আধঁ বয়সী সেই লোকটি বলে ওঠে গ্রামের রঞ্জনা নামে যে মেয়েটি তারও তো অনেক কিছু ছিল প্রতিশ্রুতি, তাই বা রেখেছে সে কটা? তার পরিবর্তন হয়েছে আর সেই লোকটির পরিবর্তন হবে না? বাসন্তী হঠাৎ বলে বসে এখানে দাঁড়িয়ে আর কথা নয় তোমার গাড়িতে আমি একটু যাব এই জায়গাটা ছেড়ে কিছুটা দূরে না হয়; সেখানেই দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলি।
আঁধ বয়সী লোকটি বলে ওঠে ও সিওর অবশ্যই এসো। গাড়িতে উঠে সোজা গাড়িটা নিয়ে এসে দাঁড় করায় বেশ অনেকটা দূরে। সূর্যসেন শিবমন্দির তার সামনে গিয়ে গাড়িটা থামে। ভেতরে বাসন্তী বলে ওঠে এখানেই নামতে হবে? আধঁবয়সী লোকটি বলে এখানে নামতে তুমি পারো তবে নামলে তোমারই একটু অসুবিধে আর ঠিক এ রাস্তা দিয়েই একটু এগোলেই কলেজ স্টিট মোড়েই আমার বাড়ি। যদি তুমি যেতে চাও তাহলে যেতে পারো।
সে কি গো! তা কি করে সম্ভব? বাড়িতে তোমার বউ আছে তো! বাসন্তী বলে ওঠে। বউ থাকুক বা না থাকুক সেটা নিয়ে সমস্যা নয়। আমার বাড়িতে অতিথিকে আপ্যায়ন করেছি। তার যত্ন তার সম্মান রক্ষা, দুটোর দায়িত্বই আমার। বাসন্তী বলে ওঠে তা বলে এই মাঝ রাতে অতিথি আপ্যায়ন সেটাও বেমানান নয় কি? আঁধ বয়সী লোকটি বলে ওঠে অনেক পরিবর্তন হলেও সেই খুনসুটি র অভ্যাসটি এখনো একই রকম আছে দেখছি। দুজনই হেসে ওঠে। বাসন্তী নিজের মনেই নিজে বলে ওঠে আজ বহু বছর পরে সে যেন প্রাণ খুলে হাসতে পারছে। মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় অতিথির বাড়িতে সে যাবে।
গাড়ি নিয়ে সোজা দাঁড় করায় তিন তলা বাড়ির সামনে গেটের কাছে। দুবার হর্ন বাজাতেই কেউ একজন কোলস্টেবল গেট খুলে বেরিয়ে আসে ওই বাড়ির নির্দিষ্ট দারোয়ান। গেট খুলতে খুলতে বলে দাদাবাবু আজ অনেক রাত হল, খাওয়া-দাওয়া করেছেন? গিয়েই তো শুয়ে পড়বেন। ফোন করে বলেও তো দিতে পারতেন। কি খাবার আনব বাকি বৃত্তান্ত। আমি দুবার চেষ্টা করেছি, ফোনে লাইন পাইনি, যে রাত হয়েছে এখনো তো কিছু খাবারই পাওয়া যাবে না। কি খাবেন? ভেতর থেকে বাসন্তী বেরিয়ে আসতে আসতে বলে ওঠে আজ রাতের দাদা বাবুরর খাবার আমিই তৈরি করে দেবো। দাড়োয়ানের চেনা না হলেও তারই মনিবকে নিয়ে এমন সময়োচিত বক্তব্যে খুশি হয়ে বলল, তবে তো খুব ভালোই হয় মা । আপনি আসুন আমি দাদাবাবুর ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছি।
ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বালিয়ে আধঁবয়সি সেই লোক বলল, এসো ভেতরে এসো । একটু রিলাক্স করো, একটু চা খেয়ে আমরা কথায় মাতব। হঠাৎই বাসন্তী বলে ওঠে কিন্তু রঞ্জনা এখন চা খেয়ে কথায় মাতবে না। রাতের খাওয়া তো কিছু খেতে হবে। বরং বলো ঘরে কি আছে? তাই দিয়েই একটু রেঁধে দিই, নইলে রাতে কি না খেয়ে থাকবে? বহু বছর পর আজ রঞ্জনা নামটি কানে ভেসে উঠলো সেই আধঁ বয়সী লোকটির কানে। বাসন্তী আরও একটু বললো, রঞ্জন তুমি বরং একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি একটু স্নান করে রান্নাঘরে যাব। তবে একটা অনুরোধ তোমার বউয়ের একটা কাপড় আমায় দিও। এ কাপড় শুভ নয়। রান্নাঘর অত্যন্ত শুভ।
রঞ্জন বেশ খানিকক্ষণ আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কোন শাড়িটি আজ পড়তে দেবে ২৫ বছরের পুরনো বন্ধুকে তার স্বপ্নের রঞ্জনাকে। ভাবতে পারেনা রঞ্জন এভাবে একসাথে আবার দেখা হবে তারই বাড়ির কাছে কোন এক জায়গায়। অনেক খুঁজে শেষে একটি লাল পাড় সাদা শাড়ি বের করে নিয়ে আসে রঞ্জনার সামনে। রঞ্জনা শাড়িটা দেখেই বলে ওঠে এত বছরের পুরনো ভালোবাসা মনে আছে এখনো। যে বয়সে গ্রামে ছিল রঞ্জনা তখন ওর প্রিয় শাড়ি ছিল লাল পাড় সাদা শাড়ি। গ্রাম ছেড়ে আসার পর আর কোনদিন রঞ্জনা ওই লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়েনি। এই ক বছরে অনেক ঝড়, অনেক ঝঞ্ঝা অনেক পরিবর্তন পার করেছে রঞ্জনা ।কখন যে রঞ্জনা পরিবর্তন হয়ে বাসন্তী নামে স্বীকৃতি পেয়েছে তা সে আজ নিজেই হয়তো স্পষ্ট বলতে পারবেনা। যত্ন করে শাড়িটা পড়ে রঞ্জনা রান্নাঘরে প্রবেশ করে।
বেশ খানিকক্ষণ পরে এসে রঞ্জনা, রঞ্জনকে বলে খাবার প্রস্তুত আমরা এবার রাতের ডিনারে বসবো। ২৫ বছর আগে গ্রামে পিকনিকের আসরের কথা মনে পড়ে রঞ্জনের। ওই সময় রঞ্জনা এই রান্নার কাজে থাকতো । শাসন ক্ষমতা বেশ ভাল ছিল অন্যান্য সকলকে ধমকে খাবারের থালা পেতে, যত্ন করে খাবার বেড়ে দাওয়ার স্মৃতি আবার ফিরে পেল। যখন সাজানো খাবার থালা নিয়ে এসে হাজির হলো খাবার টেবিলে।
কিছুটা নিস্তব্ধ সময় কাটালো দুজনে হয়তো দুজনেই তাদের পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে ছিল ব্যস্ত। সেই নিস্তব্ধতা ভাঙলো রঞ্জনই। আচ্ছা রঞ্জনা তুমি রঞ্জনা থেকে বাসন্তী কিভাবে হলে? একটা নিস্তব্ধতার মাঝেই রঞ্জনার মৃদু অট্টহাস্য নিস্তব্ধতার স্ফুলিঙ্গকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করলো। বলল রঞ্জনার গ্রামের জীবনের পর অনেক রাস্তা তাকে হাঁটতে হয়েছে। জীবন নদী দিয়ে বয়ে গেছে বহু কাল। বহু ঘটনার সাক্ষী সে থেকেছে আজকের তারিখ অবধি। বড় হবার স্বপ্ন মাঝে মধ্যে যে চরম কঠিন হয় তার প্রমাণ রঞ্জনা নিজে।
গ্রামের আর পাঁচটি মেয়ের মত রঞ্জনাও ছিল একজন। তবে ছোটবেলা থেকেই রঞ্জনার মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল অনেক খানি। গ্রামে থেকেও যে সাহসিকতার পরিচয় রঞ্জনা দিয়েছে তবে তার সেসময়ের সাহসিকতাকে সাহসিকতা না বলে উশৃঙ্খলতা বললেই বেশি ভালো হয়। হাজার উৎশৃঙ্খলতার মধ্যেও রঞ্জনার নাচ রঞ্জনার চালচলন গ্রামের প্রায় সকলেরই আকর্ষণের কারণ ছিল। হয়তো তার এই আচরণের জন্যই হঠাৎই নজরে পাড়ে শহরে কাজ করতে যাওয়া কোন এক চক্রের । তারাই রঞ্জনাকে শহরে নিয়ে গিয়ে আরো বড় কাজের সুযোগ করে দেবে, সে অনেক বেশি পয়সা উপার্জন করতে পারবে এই লোভ দেখায় রঞ্জনাকে। আধুনিক হলেও গ্রামের সারুল্যতাই রঞ্জনা ও তার পরিবার, ভবিষ্যৎ বিপাকে পড়ার প্রথম বা প্রধান কারণ হয়েছিল।
একটি বিশেষ চক্রের হাতঘুরে রঞ্জনা গিয়ে উঠেছিল উত্তর কলকাতার একটি বাড়িতে। সেখানেই তার প্রথম শহুরে জীবনের শুরু। অচেনা শহর অজানা জায়গা, প্রথম শুরুটা তেমন খারাপ যায়নি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার অনুষ্ঠানের সুযোগ যেমন ঘন ঘন বেড়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি পয়সা উপার্জন করছিল সে সময় অনেক বেশি। কিন্তু এই অবাঞ্ছিত রোজগারই রঞ্জনার বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ালো । বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন নতুন অফার আরো বেশি উপার্জনের লালসা তাকে পেয়ে বসল। তারপর হঠাৎই নিজের অজান্তেই কোন একদিন সে এসে পৌঁছালো এই হার-কাটা গলির কোন এক দিদির ডেরায়।
কলকাতার হার-কাটা গলি বেশ পরিচিতি ছিল উনবিংশ শতকের তথাকথিত বাবু সম্প্রদায়ের কাছে। সেই পরিচিত হার-কাটা গলির বাসিন্দা হয়ে উঠল রঞ্জনা। নিয়ম অনুসারেই রঞ্জনা পরিচিত হল এক নতুন নামে; নাম তার হলো বাসন্তী। কোন এক বসন্তের সন্ধ্যায় উঠেছিল এই গলিতে । তার থেকেই তার নাম বাসন্তী হয়েছিল কিনা জানা নেই; তবে রঞ্জনা হঠাৎই পরিচিত হয়ে উঠল নতুন বাসন্তী রূপে।
তখন কিশোরী বাসন্তী যৌবনে ভরপুর। প্রথম দিন কোন এক বাবু তাকে পছন্দ করে। তাদের দিদি তাকে নির্দেশ দেয় সেই বাবুকে নিয়ে তার ঘরে যেতে। আর বাবুর যাতে কোনরকম কোন আনন্দে খামতি না হয় সেদিকে বিশেষ ভাবে নজর রাখতে। হার-কাটা গলির তেমন রীতিনীতি জানা ছিল না সেই রঞ্জনা ওরফে বাসন্তীর। তাই সেই বাবুর আদর খেয়ে প্রথম বেশ রাগান্বিতই হয়ে উঠেছিল বাসন্তী। তবে একসময় সে বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে এ জায়গায় তার রাগ তার ক্রোধ তার যৌবনকে পরাস্ত করতে সক্ষম হলেও, তাদের দলনেত্রী দিদির নির্দেশিকা অমান্য করার মতো ক্ষমতা এই হার-কাটাা গলির কোন মেয়েরই নেই। নিজের অজান্তেই এই হারকাটা গলিতেও সেরার সেরা হয়ে উঠল রঞ্জনা ওরফে বাসন্তী। ছোট, বড়, কিশোর বৃদ্ধ কারোর কাছেই কোন খেলাতেই পরাস্ত নয় বাসন্তী। তাই দিদির কাছেও সে বেশ প্রিয় পাত্রী হয়ে দাঁড়ালো। সে সময়ে হারকাটা গলির কমলাদির তো তুরূপের তাস হয়ে উঠেছিল ওই বাসন্তী।
তবে যৌবন তো সারা জীবন থাকে না । একদিন সেই যৌবনকেও হারাতে হয়। বাসন্তী তেমন বৃদ্ধ না হলেও হাড় কাটা গলির জীবিকার দৌলাতে যৌবনের মাঝ গগনের পরেই ধীরে ধীরে বৃদ্ধ না হয়েও বৃদ্ধের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় বা হয়েছিল আর পাঁচজন মেয়ের মতোই । তাই হঠাৎই যে বাসন্তী দুহাতে রাত দিন কামিয়েছিল অজস্র পয়সা, আজ সেই বাসন্তীকেই দেয়ালের গায়ে কিংবা গলির মুখে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে শোনা যায় আয়না বাবু, সন্ধ্যে থেকে দাঁড়িয়ে আছি, চলনা বাবু সব আনন্দই পাবি; কোনটাই অভাব হবে না। তাতেও সব সময় চিরে ভেজাতে সক্ষম হয় না রঞ্জনা।
জুন মাসের সন্ধ্যা রাত। গত দুদিন ধরে টানা বৃষ্টির খেলা; সকাল, বিকেল, সন্ধ্যের বিরাম নেই তার। গতকাল এক বাবুর দৌলতে বেশ অনেকদিন পর বাসন্তীর দুটো মোটা টাকা জুটলেও আজ সন্ধ্যা থেকে রাত পোহালো প্রায় বারোটা তবুও তেমন খদ্দের জুটলো না বাসন্তীর কপালে। ক্লান্ত বাসন্তী একটু এগিয়ে কারবারের তাগিদে ঘুরে বেড়ায়। হঠাৎই বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যায়। তাই একটু সেড খুঁজে দাঁড়ায় বাসন্তী। পরনে নীলচে শিফন শাড়ি তারই সাথে রক্ত রাঙা ব্লাউজ । যৌবন বয়সের হিসেবে চলে যায়নি । বাসন্তীর খদ্দের তেমন না জুটলেও খদ্দেরেরা আর চোখে দেখতে ভোলে না বাসন্তীকে। কেউবা যারা সাহস পায় সামনে এসে দরদাম করতে। কিন্তু এমন অনেক গুটিকয় পয়সাওলা বাবু, তারা তেমন কদর আর এখন দেয় না বাসন্তীকে। ক্লান্ত বাসন্তী দাঁড়িয়ে ভাবে আজ রাতে বোধহয় তার কপাল শূন্যই থাকবে। বৃষ্টিতে বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে তার শাড়ি। ভেজা শাড়ি লেপ্টে আছে তার ভারী দুই যৌবনকে। পোষ্টের আলোয় আলো-আঁধারিতে হয়ে উঠেছে সে এক লাস্যময়ী। এই লাস্যময়ী রূপে কলকাতার অনেক তাঁবোর বনেদি ব্যবসায়ী, কিংবা বড় মহাজন খাবি খেয়েছে বার বার। তবু আজ সেই বাসন্তী সন্ধ্যা থেকে দাঁড়িয়ে মাছি মারছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাসন্তী। ভাবতে থাকে তার ধারাবাহিক জীবন ইতিহাসের কথা । কিছুটা ভাবায়ও তাকে । বয়স তো বসে থাকে না । আগামী বয়সকালে সে কিভাবে কাটাবে তার এই ক্ষুদ্র জীবন!
হঠাৎই গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছিল তার সামনে তারপর মুহূর্তের মধ্যে বাসন্তীকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক অন্য জগতে। দুজনে জামা কাপড় পরিবর্তন করে বাসন্তী ওরফে রঞ্জনা বহু বছর পরে আজ আবার নতুন ভাবে রান্নাঘরে প্রবেশ করল। রান্নাঘরটা তেমনভাবে গোছানো ছিল না। নিজে হাতে রান্নাঘর গোছাতে গোছাতে একবার তার মনে খটকা লাগলেও, পরবর্তীতে তার মনে হয়েছিল এ বাড়ি এ ঘর তার নিজের, তার একান্ত আপন। বেশ কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার তৈরি করে এসে ডাইনিং টেবিলে খাবার রাখে রঞ্জনা। শোবার ঘরে গিয়ে দেখে রঞ্জন তখনো উদাস মনে তাকিয়ে হাতে সিগারেট ধরে বসে আছে। রঞ্জনার ডাকে তার হুশ এলো। ঘড়ির দিকে তাকাও কটা বাজে? খেতে হবে তো রাতে।
গ্রাম ছাড়ার পর আজ বহু বছর বাদে আবার রঞ্জন - রঞ্জনা একসাথে খেতে বসলো। নিস্তব্ধ পরিবেশে রঞ্জনার কথাতেই নিস্তব্ধতা ভাঙলো। রঞ্জন, আমি শুনেছিলাম তুমি বিয়ে করেছ স্ত্রী সন্তানাদি তার কিছু খবর? হঠাৎ রঞ্জন বলে উঠলো অভাগার কিবা দিন কিবা রাত। আমি ভালবাসতে চেয়েছিলাম অথচ ভালোবাসা আমার কপালে জোটেনি, কেবলই পন্য হয়ে আমার কাছে ভালোবাসা ধরা দিয়েছে বারবার। ছোট্ট সংসার সন্তান আমি আর তুমি যাতে নিজেকে বারবার বাঁধতে চেয়েছিলাম । অথচ সেই বাঁধন কোনদিন টেকেনি আমার কপালে। তোমার সাথে ভালোবাসার ছেদ হবার পর ভালোবাসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম অনেক দূরে। নিজের কাজ বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখা এমনটাই আমার জীবনের ঘড়ির কাটা হয়ে উঠেছিল। শেষে বাবা মার দেখে দেওয়া পাত্রীকেই বিবাহ করলাম একদিন। আমার ক্ষমতা, আমার অর্থ, সবকিছু উজাড় করে দিতে চেয়েছি তাকে বারবার। কিন্তু কোনদিন তার খিদে পূর্ণ করতে সক্ষম হয়নি। একসময় বুঝতে পারলাম সে শুধু আমাকে নয় তার আরো পাঁচজনকে দরকার। বোঝাবার চেষ্টা করলাম বহুবার; পরিণতিতে হয়তো আরো খারাপ কিছু ঘটল । নিজের চোখে তা দেখে সহ্য করতে পারলাম না, তার বেপরোয়াকে। একটা সময়ে ঘরে বাইরে আমার সম্মান, আমার পরিবারের সম্মান সমস্ত কিছু বার বার ভাঙতে লাগলো। প্রতিবার ক্রোধান্বিত হয়ে রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি । প্রতিবার ক্ষমা করে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। সন্তানটাও একটু একটু করে বড় হতে লাগলো তার কাছে একটা সময়ে ওই আপেক্ষিক আনন্দটাই সমর্থনযোগ্য হল । মায়ের দলদাসে পরিণত হয়ে উঠল সেও। প্রতিনিয়ত একটা প্রতিযোগিতায় শামিল হল মা আর মেয়ে। আমি আর পারলাম না হঠাৎই এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ঘরের বেশ কিছু জিনিস লন্ডভন্ড। কিন্তু আমার স্ত্রী আমার মেয়ে! হন্নে হয়ে খুজলাম সমস্ত বাড়ি। সদ্য দেড় বছর হয়েছে আমার একমাত্র অবলম্বন মাকেও হারিয়েছি। আত্মীয়, পরিজন , সবশেষে থানা পুলিশ সবকিছু করার পর তিন মাস কেটে যাবার পরে জানতে পারলাম; মেয়ে ও মা তারা কলকাতার আলিপুর অঞ্চলে সম্ভ্রান্ত ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে বহু পয়সার অধিকারী। আর সাথে আরও কিছু। ঘৃণায় লজ্জায় নিজেকে সরিয়ে নিলাম চিরতরে। জান সেদিন ভীষণ মনে পড়েছিল তোমাকে। রঞ্জনা, জানো নিজের মনে ডুকড়ে উঠলাম। ছোটবেলায় যাকে ভালবেসেছিলাম সেও চলে গেছে, বিক্রি করে দিয়েছে নিজেকে ; পয়সা কামাবার এক অদম্য নেশায়। আজ আমি নিঃস্ব । আমার অর্থ আছে সম্মান আছে ।অথচ আমি যে ছোট্ট সংসারের কাঙ্গালি ছিলাম , শুধু সেইটুকুই নেই।
চুপ করে শুনছিল রঞ্জনা। নিস্তব্ধ ঘরে একটা পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। হঠাৎই করে কাটল সেই নিস্তব্ধতা। রঞ্জনা বলে উঠলো রঞ্জন, আমি জানি আমি ভীষণ থেকে ভীষণ তম নোংরা । আমি বাজারের বহু বহু লোককে আনন্দ দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমিও বাঁচতে চাই । আমিও সংসার চাই । আমি সন্তান চাই। আমি শুধু একটুখানি মায়ের ডাক শুনতে চাই। কিন্তু কোন মুখে আমি আজ, আজ তোমাকে বলবো রঞ্জন আমাকে বিয়ে করবে? আমি যে, আমি যে সত্যিই খুব, খুব অপবিত্র হয়ে গেছি রঞ্জন । তোমার সেই পবিত্র ভালবাসার মূল্য টুকু আমি দিতে পারিনি। রঞ্জন হঠাৎ চমকে ওঠে! রঞ্জনা তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো ? যে ভালবাসায় আমরা একে অপরে অন্ধ ছিলাম সেই ছোট্টবেলায়। রঞ্জনা বলে ওঠে, পারবে কি তুমি আমায় ক্ষমা করতে? এই পণ্য, বেশ্যা মেয়েটিকে পারবে তুমি আপন করে নিতে? রঞ্জন বহু বছর পর ওই আলো-আঁধারি ঘরে একটা উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। ছুটে এসে দুই বাহুডোরে রঞ্জনাকে আগলে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমার রঞ্জনা এখনো বেঁচে আছে।
দীর্ঘ বছর পর আবার রঞ্জনা আর রঞ্জন বসল একসাথে। বলতে লাগলো কিভাবে সেই গ্রামের রঞ্জনা বাসন্তীতে পরিণত হয়েছিল তার বিস্তৃত বিবরণ । গ্রাম থেকে ফিরে তারা প্রথম উঠেছিল অনিল এর বাড়িতে। মদের আড্ডা ফুর্তি আনন্দ আর সাথে একের পর এক গানের জন্য স্টেজের প্রোগ্রাম। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ভালো একটা গ্রুপ তৈরি হয়ে গেল। অর্গানাইজার বেশ ভালো প্রোগ্রামও ধরতে লাগলো। উজ্জ্বল গায়ের রং। দিনগুলো খুব ভালো কাটতো তবে আনন্দ মজলিস এসবের মধ্যে মাঝেমধ্যে দৈহিক মজলিস তাও বাদ যেত না। একটা অন্য জগতে ঢুকে পড়েছিলাম আমি।
সেই দিনটা ছিল পুজোর সময় অনেক রাতেই আমরা প্রোগ্রাম করে ফিরলাম রাতে গাড়িতে ফেরার পথে মধু খাওয়া হয়েছিল অনেক বেশী। ক্লান্তই ছিলাম আমি। বাড়িতে ঢোকার পর দৈহিক ক্লান্তি আমাকে বিছানায় টেনে নিল খুব তাড়াতাড়ি। স্বতন্ত্র ঘর থাকলেও তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না ওই গ্রুপের কে কোন খানে শোবে বা মেয়েদের আলাদা করে শোওয়া এমন কোন স্থিরতা থাকতো না। আমাদের গ্রুপে চারটি ছেলে দুটি মেয়ে থাকতাম। এনজয়মেন্ট এর তাগিদে মাঝেমধ্যে উদোম খেলা যে মাততাম না তা নয়। তবে মদের নেশায় তা হয়তো করতে পারতাম না। সেদিনও তাই হয়েছিল। তবে জানতাম না আমার সহযাত্রী যে মেয়েটি তুলিকা কারো সাথে কন্ডিশন করে নিয়েছে আজ রাতে তারা উদ্দাম খেলায় মাতবে। তাই তারা নেশায় মাতলেও তারা তাদের কন্ডিশন বজায় রাখল। বাড়িতে ঢোকার পরেই তারা তাদের স্ব রূপে প্রকাশ পেল। আমিও পাশে বসে উপভোগ করছিলাম ওদের উন্মাদানাকে। একসময় সেই উন্মাদনায় আমিও হঠাৎ করেই জড়িয়ে পড়লাম। সেই দিনই প্রথম তুলিকা যার সাথে আনন্দে মেতেছিল তার সাথে আমার খেলা। এক সময় যখন ক্লান্ত হয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। কিন্তু হঠাৎ ভোর রাতে ওদের অট্টহাস্যে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওদের ঐ আলোচনাটায় আমায় খটকা লাগালো। কাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল বুঝতে পারলাম না, তবে এটুকু বুঝতে পারলাম ওদের ওই আলোচনায় ওরা স্টেজের প্রোগ্রাম বা গানের প্রোগ্রাম ছাড়াও ওরা আরো কোন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে। যেহেতু কাকে নিয়ে আলোচনা তা বুঝতে পারছিলাম না তাই তেমন কৌতুহল জাগল না আমার; তাদের এই আলোচনাটার মুখ্য বিষয় কি তা নিয়ে।
এরপর থেকে কেন জানি সেই ছেলেটি সুদীপ আর তুলিকার নজর বা আচরণটা অনেকটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। সুদীপের নজর কেবল আমার উঠতি যৌবনের ওপরেই তা বুঝতে অসুবিধের হলো না ছলে বলে অনেকবারই মাতল উদ্দাম খেলায় আমার সাথে। মাঝেমধ্যে এমন বক্তব্য বলতো জানিস তুই যা খদ্দের জটাতে পারবি তা অনেক মেয়েই পারবে না। তোর ওই আগুনের কাছে অনেক বড় ক্ষমতাবান ছেলেও মুশরে পড়বে। আর পয়সা তোর কোনদিন অভাব হবে না তোর আগুনই তোকে পয়সা এনে দেবে অনেক অনেক বেশি। আমি জানতাম না আমার কৃতির সঙ্গে আমার বিপরীত খেলোয়ার কত বেশি তৃপ্তি পাচ্ছে। কারণ তখনো পর্যন্ত আমি খদ্দের সন্তুষ্টের জন্য খদ্দেরের কারক হইনি।
সেদিন শরীরটা তেমন ভাল ছিলনা, গতকালই পিরিয়ড হয়েছে ক্লান্ত শরীরে শুয়েছিলাম ঘরে। পাশের ঘরে আমাদের গ্রুপের অন্য কয়েকজন আড্ডা মারছিল। ওদের এই গ্রুপে সেদিন সুদীপও ছিল। কিছুক্ষণ পর আমার ঘরে এসে এক অজানা আনন্দে ভরিয়ে দেবার তাগিদে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিনও কিন্তু শরীর তেমন পারমিট করেনি বলে সরে দাঁড়ালো সুদীপ। তুলিকাও ওর সাথেই ছিল। উদ্দাম খেলার নেশা সুদীপের চাপলে সুদীপ তা দমাতে সক্ষম নয়, তা আমারো জানা তবে আজ আমার সেই ক্ষমতা নেই বলেই হয়তো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবে এই তাগিদেই তুলিকার সাথে খেলায় মাতলো আর সে সময়েই ওদের আলোচনায় আমি আজ করতে পারলাম ওরা কোন একটা বড় ফন্দি আঁটছে। তবুও তেমন পরিষ্কার বোঝার ক্ষমতা হলো না। পরের দিন সন্ধ্যায় সুদীপ সিগারেট খেতে খেতে আমার ঘরে এসে বলল রঞ্জনা একটা ভালো কাজের অফার আছে তবে তোকে ওখানেই থাকতে হবে। দিল্লিতে একটা হোটেল ওখানে ই তুই গান নাচ দুটোই করতে পারবি আর সাথে একটু একটু খদ্দের এন্টারটেইনমেন্ট তাতে উপরী ইনকাম খারাপ হবে না।
সুদীপের প্রস্তাবটা সেদিন কেন জানি খারাপ লাগেনি, পরের দিন ভোরবেলাতেই হাওড়া থেকে দিল্লি গামী গাড়িতে উঠে পড়লাম। তেমন চেনা না হলেও দিল্লির চাঁদনী মার্কেটের পাশেই আমার সাময়িক বাসস্থান হল। হোটেলে গান নাচ আর পাবলিক এন্টারটেইনমেন্টে আমি সারা জাগিয়ে ফেললাম ওই এলাকায়। এক সময়ে ওই হোটেলে বাঙালি মেয়েকেই চাই এমন একটা রব উঠে গিয়েছিল। আমিও সে সময়ে যৌবনের নেশায় আর অর্থের লালসায় আমি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম।
ওখানে ই একদিন পরিচয় হল এক সুদর্শন বাঙালি বাবুর সাথে নাম তমঘ্নো। বেশ কমার্স সে আনন্দ নিল আমার কাছে। আর প্রতিদিন দুহাতে পয়সা ঢেলে দিয়ে যেত আমায়। আর আমার আরম্বরতার চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল সে। একদিন সন্ধ্যায় সেই এসে বলল তার কলকাতায় একটা বিজনেস আছে আর সে চায় সেই বিজনেসের অন্যতম পার্টনার করতে আমাকে। প্রস্তাব শুনে খারাপ লাগেনি । অর্থ আছে যৌবন আছে আকর্ষণ তাও কম নয় আর তার সাথে যদি কোন বিজনেসের পার্টনার তা খারাপ কি?
সেই কথা অনুসারে ই পরের দিন ব্রেকফাস্ট করে দিল্লি থেকে আবার রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে রাতে খাবার পর শরীরটা তেমন ভালো লাগছিল না। তমোঘ্ন বারবার খোঁজ নিতে লাগলো শেষে বলল তার বাড়ি বেশ খানিকটা দূর তবে তার পরিচিত একটা জায়গা আছে মধ্য কলকাতায়। আজ রাতে সেখানেই সে উঠবে আগামী কাল তাকে ডাক্তার দেখিয়ে তারপর তার বাড়িতে সে নিয়ে যাবে। সেই কথামতোই আধ অচেতন অবস্থায় আমাকে নিয়ে মধ্য কলকাতার সেই বাড়িতে উঠেছিল সেদিন রাতে আমার তেমন কোন জ্ঞান ছিল না। ডাক্তার এসেছিল আমাকে দেখেও ছিল। বলেছিল আমি পোয়াতি। কিন্তু আমি নিজেও বুঝতে পারিনি তার ঔরস কর্তা কে? বেশ ক'দিন ওই বাড়িতে ছিলাম পরপর দুদিন ওকে দেখতে পেয়েছিলাম ভালো মন্দ দুচার কথা এই পর্যন্তই। তারপর একদিন দুদিন করে কয়েক মাস কেটে গেল তমঘ্নোর দেখা আর পেলাম না। জানতে পারলাম ওই বাড়িতে আমার মতন অনেক মেয়ে থাকে আর তাদের পরিচালিকা হিসেবে একজন মহিলা আছেন। তিনি একদিন আমায় এসে বললেন এখানে তোমার নামে তোমাকে কেউ ডাকবে না তাতে তোমার অসুবিধে হবে তোমার নাম আমি দিলেম বাসন্তী। আমি হঠাৎই জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাসন্তী কেন? মুচকি হেসে সেদিন সে বলেছিল এখন কি কাল? আর তুমি বসন্তের মতোই ভরা যৌবনে ভরপুর। তুমি বাসন্তী না হলে আর কে হবে? সেদিন থেকেই আমি আজকের বাসন্তী।
বাইরে আলোর রোসনাই অনেকটা বেড়ে গেছে সারারাত না ঘুমালেও দুজনের কারোরই ক্লান্তবোধ এতোটুকু দেখা গেল না। হঠাৎই দুজনই একসাথে বলে উঠলো আমরা স্নান করে কালীঘাটে যাব। আর সেখানেই আমাদের চার হাত একসঙ্গে হবে। হঠাৎ বাসন্তী ওরফে রঞ্জনার মোবাইল বেজে উঠলো হাড় কাটা গলির মেয়ে তো সে । তাদেরই মাথা দিদি কিংবা মাসি ফোন করছে তাকে, ফেরেনি ডেরায় তাই জিজ্ঞাসা। ঝামেলা হতে পারে এমন ভেবেই সাত সকালেই রঞ্জন লালবাজারের তার বিশেষ বন্ধু পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করে নিয়েছিল। তাই তেমন চিন্তা না করলেও কিছুটা ব্যাকুলতা নিয়েই তারা দুজনেই তৈরি হলো তাদের নতুন জীবন শুরু করবার জন্য পবিত্র হবে বলে।
সেদিন ভাগ্যক্রমে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। তেমন গোড়া হিন্দু না হলেও পাজি নামক বিষয়টি একটু মানতে ভালোবাসে রঞ্জন। তাই পাজি খুলে বিয়ের তারিখ দেখতে গিয়ে হঠাতই আনন্দে চিৎকার করে বলল আজই বিয়ের তারিখ আছে । লগ্ন সন্ধে ছটার থেকে রাত্রি সাড়ে নটা অবধি। আবার ভোররাতে। আর দেরি নয় দুজনেই বেরিয়ে পড়ল তাদের নতুন জীবন শুরু করবে বলে। পুরোহিতকে তাদের যৎসামান্য অর্থ প্রদান করে বিয়ের ছোট্ট আয়োজন সারলো তারা। অনেকদিন পর রঞ্জন রঞ্জনার মুখের দিকে তাকালো হঠাৎই তার হারানো সাত মানিকের ধন রঞ্জন তার রঞ্জনাকে খুজে পেল। সিঁদুর দানের সময় ঠাকুরমশাই রঞ্জন কে বলেছিল বাহ্ খুব সুন্দর করে সিঁদুর পরিয়েছেন মেয়েকে । সুখী হোন। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। আরো কারো আনুষ্ঠানিক চার হাত একসঙ্গে হয়েছে। তবে জিৎ হয়েছে তাদের দুজনেরই । তবু নতুন পথ চলার দুটি হাত শক্ত করে ধরে একে অপরে। পুরনো রঞ্জন আবার পুরনো রঞ্জনেই ফিরে যায়। হঠাৎই রঞ্জনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে "পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর"। নীড় ভাঙ্গা পাখি ফিরে আসে নীড়। আমার প্রিয়ার, প্রিয়তা হয়নি শেষ । তাই নষ্টনীড়ে আবার জেগেছে আলো।